ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ক্যাম্পাসের হোটেল, বিভিন্ন হলের ডাইনিং ও মুদি দোকান থেকে আট লক্ষাধিক টাকার বেশি বাকি খেয়ে লাপাত্তা শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তর ও প্রধান ফটক এলাকায় অন্তত ৩০টি দোকানের বাকির হিসাব থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে বড় অঙ্কের বাকির চাপে অনেক ব্যবসায়ীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক দোকানিরই এখন ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। ইতিমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কেউ নিজের হোটেল মালিকানা বিক্রি করে ব্যবসা গুটিয়ে এখন অন্যের হোটেলের কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। পাওনা টাকা উদ্ধারে নেতাকর্মীদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন তারা। তবে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। টাকা ফেরত পেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য পাঁচটি ও ছাত্রীদের জন্য তিনটিসহ মোট আটটি আবাসিক হল রয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের ভিতরে ও প্রধান ফটক এলাকায় অন্তত ত্রিশটি মুদি দোকান, হোটেল ও চায়ের দোকান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তারা এসব দোকান থেকে প্রভাব খাটিয়ে ও হুমকি-ধামকি দিয়ে বাকিতে খাওয়া ও জিনিসপত্র নিতেন। সম্প্রতি অনুসন্ধানে প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মীর নামের তালিকা পাওয়া গেছে। ক্ষমতায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সেসময় ভয়ে কেউ কথা বলতে পারেনি। তবে আওয়ামী সরকার পতনের পর এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন পাওনাদাররা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হল ডাইনিং, খাবার হোটেল ও অন্য দোকানগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মোট বাকির পরিমান ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫২ টাকা। এর মধ্যে চা-সিগারেটের দোকানে বাকি ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫২টাকা এবং ডাইনিং ও খাবার হোটেলে বাকি ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৬০০টাকা। ছাত্রদের পাঁচটি হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায় মোট বাকি ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে জিয়াউর রহমান হলে ৬০ হাজার ও লালন শাহ হলে ৩০ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। হলগুলোর ডাইনিং ম্যানেজাররা তাদের বকেয়া খাতা হিসাব করে এসব তথ্য জানিয়েছেন। এছাড়া ক্যাম্পাসের ভেতরের ও প্রধান ফটকের মোট ছয়টি খাবার হোটেলে মোট বাকি রয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ৬০০ টাকা। এরমধ্যে ক্যাম্পাসের ভাই ভাই হোটেলে দেড় লক্ষ ও প্রধান ফটকের সামনের ইবি স্ন্যাকসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বাকি রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নামে। এদিকে, ক্যাম্পাস ও প্রধান ফটকের চা-দোকানসহ অন্যান্য অন্তত ২৫টি দোকানে মোট বাকির পরিমাণ ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫২ টাকা। এরমধ্যে সর্বোচ্চ বাকি অভি ক্যাফেতে ১ লাখ ১৭ হাজার ৮৯০ টাকা। এসব দোকানের বাকীর প্রায় অধিকাংশই চা ও সিগারেট বাবদ বলে জানা গেছে।
পাওনাদাররা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ও প্রধান ফটক সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন দোকান এবং হলের ডাইনিংয়ে বছর বছর ধরে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা বাকি খেয়ে আসছিলেন। তাদের মাত্রাতিরিক্ত বাকিতে অতিষ্ঠ হয়ে দোকানিরা মাঝেমধ্যে বাকি না দিতে চাইলে তারা জোর করেও খেয়ে যেতেন। আগের বাকির টাকা চাইলে বিভিন্ন টালবাহানায় তা এড়িয়ে যেতেন। অনেক সময় কর্মীরা খেয়ে নেতার নাম বলে চলে যেত। এছাড়া লেখাপড়া না জানা দোকানিদের থেকে বাকি খেয়ে খাতায় নাম পরিচয় না লিখে শুধুমাত্র টাকার পরিমাণ লিখে রাখত বলেও জানান তারা।
দোকানিদের অভিযোগ, বাকির টাকা চাইলে তারা বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি ও হুমকিধামকি দিয়েছে। সরকার পতনের পর এখন তারাও পালিয়েছে। এখন অনেকেই কল ধরছে না আবার অনেকের মোবাইল বন্ধ। আমরা চাই, তারা যেকোনো মাধ্যমে আমাদের পাওনা টাকা ফেরত দিক।
ক্যাম্পাসের ভাই ভাই হোটেলে বাকি প্রায় দেড় লাখ টাকা। বাকির চাপে ব্যবসা ছাড়তে হয়েছে এই হোটেল মালিকের। হোটেলের মালিক আফজাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার ভাষ্য, বাড়ির জমি বিক্রি করে তিনি হোটেল চালু করেছিলেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অতিরিক্ত বাকির চাপে একেবারে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। নিজের হোটেল ব্যবসা বাদ দিয়ে এখন অন্যের দোকানে কর্মচারীর হয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাকে। যাদের জন্য এই দুরবস্থা তাদের বিচার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়েছি বলে জানান তিনি।
ইবি ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ইবি স্ন্যাকসে প্রায় এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা বাকি। এই রেস্টুরেন্টের পরিচালক এনামুল কবির জানান, ছাত্রলীগের ছেলেরা বিগত ১০/১৫ বছর ধরে আমার কাছে লক্ষাধিক টাকা বাকি খেয়েছে। টাকা না দেওয়ায় একসময় ক্ষোভে হিসাব রাখা ছেড়ে দেই। এখন আমাকে লোন নিয়ে দোকান চালু করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
লক্ষাধিক টাকা বয়েকা থাকা অভি ক্যাফে শপের মালিক আলমগীর হোসেন। তার ভাষ্য, ছাত্রলীগের ছেলেরা তার দোকান থেকে চা-সিগারেটই বেশি খেত। টাকা চাইলে ক্যাম্পাসে ব্যবসা বন্ধ করার হুমকি দিত এমনকি জোর করে নিজের ইচ্ছামতো সিগারেট নিয়ে চলে যেত বলে জানান তিনি।
ইবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের ভাষ্য, লেনদেন সকলের জন্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে যে কারো বাকি থাকতে পারে। আমার আহ্বান থাকবে ছাত্রলীগের কারোর যদি কোনো দোকানে বাকি থাকে তাহলে তারা যেন টাকা পরিশোধ করে দেয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মামুন অর রশীদ চ্যানেল 24 কে বলেন, ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে মানবিক দিক বিবেচনায় অবশ্যই উচিত যার যেখানে যে পরিমাণ বকেয়া আছে সেইটা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা।