25 C
Dhaka
Sunday, December 22, 2024
[adinserter block="1"]

সমাজসেবা যখন ব্যবসা

দিন দশেক আগেও মিল্টন সমাদ্দার নামটি আমার কাছে প্রায় অচেনাই ছিল। তিনি সমাজসেবা করেন, পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে মানুষের সেবা করতেন; এটুকুই জানতাম। কিন্তু তার সমাজসেবার ধরন, অর্থের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। প্রায় দুই কোটি লোক যাকে ফলো করেন, তার সম্পর্কে এত কম জানা নিয়ে আমার মধ্যে একটু অপরাধবোধও ছিল। স্বীকার করছি, একজন সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার ব্যর্থতা। আমার ব্যর্থতা পুষিয়ে দিতেই যেন মাঠে নামল দৈনিক কালবেলা। দারুণ এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে তারা মিল্টন সমাদ্দারের গোমর ফাঁস করে দেয়। কালবেলার প্রতিবেদন প্রকাশের পর মিল্টন সমাদ্দার সারা দেশের সাধারণ মানুষের আলোচনায় পরিণত হন। কালবেলার রিপোর্ট অবশ্য অনেকে বিশ্বাস করেননি। অনেকেই বলেন, কালবেলা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমাজকর্মী মিল্টন সমাদ্দারের পেছনে লেগেছে। অনেকে এমনও বলছেন, এভাবে গণমাধ্যম পেছনে লাগলে কেউ আর ভালো কাজ করতে এগিয়ে আসবে না। অনেকেই কালবেলার রিপোর্টের নানা ত্রুটি তুলে ধরেন।

এটা ঠিক, মিল্টন সমাদ্দার সহায়তা না করায় কালবেলার অনুসন্ধানে অনেক ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে, কিডনি বিক্রি করার অভিযোগটি আমার কাছেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রক্রিয়া অনেক জটিল। কারও শরীর থেকে গোপনে কিডনি সরিয়ে ফেলে তা অন্য কারও শরীরে সরাসরি প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। অন্য অনেকের মতো আমারও কালবেলার প্রতিবেদন নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়ে গিয়েছিল। আমার সংশয় দূর করে দিয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার স্বয়ং। কালবেলার প্রতিবেদনের পর প্রায় সব গণমাধ্যমই মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে। কালবেলাকে সহায়তা না করলেও অন্য অনেক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। নিজের ফেসবুক পেজেও আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন মিল্টন। তার বেশ কিছু বক্তব্য শোনার পর আমার সব সংশয় দূর হয়ে যায়। তার বক্তব্যে অনেক গোঁজামিল ছিল। কথা শুনে তাকে আমার স্রেফ ধূর্ত ও চালিয়াত মনে হয়েছে। মিল্টন সমাদ্দারের বক্তব্য শোনার পর আমার যেসব বন্ধু তাকে ভালো মানুষ বলছিলেন, তাদের বলি, এ লোকের ঘাপলা আছে। তার বক্তব্য শোনার পর আমি বিশ্বাস করি, অনুসন্ধানে কিছু ত্রুটি থাকলেও কালবেলার প্রতিবেদন মোটা দাগে সত্যি।

আরো পড়ুন  দেশে টিকটকের বর্ষসেরা ক্রিয়েটর আয়মান-মুনজেরিন

মিল্টন সমাদ্দার রাস্তার অসহায়, অসুস্থ, ভবঘুরেদের তুলে এনে তার প্রতিষ্ঠিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ কেন্দ্রে আশ্রয় দিতেন। এ তুলে আনা এবং আশ্রয় দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি তিনি ভিডিও করে তার ফেসবুক পেজে প্রচার করতেন। এ প্রচারণার জন্য তার ছিল ১৬ সদস্যের একটি টিম। ফেসবুক বুস্টের পেছনে তিনি মাসে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করতেন। মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে তাদের জন্য তিনি বিত্তবানদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। দেশ ও প্রবাস থেকে তার আবেদনে প্রচুর সাড়াও মিলত। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হতো। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়ে আসতেন। কিন্তু এর পুরোটাই ছিল আসলে মুখোশ। সেই মুখোশের আড়ালেই ছিল মিল্টন সমাদ্দারের ভয়ংকর চেহারা। এখন পর্যন্ত যা খবর জানা যাচ্ছে, তাতে তাকে একজন সাইকোপ্যাথ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।

রাস্তা থেকে তুলে আনা অসুস্থ, অসহায় মানুষগুলো মিল্টন সমাদ্দারের কেন্দ্রে গিয়ে মাথার ওপর ছাদ, খাবার হয়তো পেতেন। কিন্তু মিল্টন তাদের কোনো চিকিৎসা দিতেন না, সেবা দিতেন না। উল্টো ভয়ংকর নির্যাতন চালাতেন। আসলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মিল্টনকে গ্রেপ্তারের পর ভেঙে পড়ে তার প্রতারণার সাম্রাজ্য। তিনি এখন গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে আছেন। রিমান্ডে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, মিল্টন কখনোই অসুস্থ ব্যক্তিদের কোনো হাসপাতালে নিতেন না। বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে যাদের শরীরের কোনো অংশ পচে যেত, সে অংশগুলো মিল্টন ছুরি ও ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতেন। বেশ কয়েকজন বৃদ্ধের তিনি হাত, পা ও আঙুল কেটে ফেলেন। সে সময় তাদের কান্না, যন্ত্রণা ও রক্ত দেখে মিল্টন পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতেন। তার ‘অস্ত্রোপচার কক্ষে’ শুধু কয়েকটা ছুরি ও ব্লেড পাওয়া গেছে। সেখানে তিনি নিজেই ‘অস্ত্রোপচার’ করতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৯০০ মরদেহ দাফনের দাবি করলেও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন ১০০ মরদেহের হিসাব দিতে পেরেছেন। এ মরদেহ দাফনের জন্যও প্রয়োজনীয় ডেথ সার্টিফিকেট বা ডাক্তারের কোনো কাগজ থাকত না। যা থাকত তাও জাল। কারণ তার কেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। রাস্তা থেকে তুলে আনা মানুষের শেষ পরিণতি হতো বিনা চিকিৎসায়, নির্যাতনে, ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু। মানুষের এ নির্যাতনই ছিল মিল্টনের আনন্দ। তার অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা থাকলেও তিনি তা আশ্রিতদের কাজে ব্যয় করতেন না, বরং ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসেই ব্যয় হতো সমাজসেবার জন্য পাওয়া অর্থ।

আরো পড়ুন  রিজিকের মালিক আল্লাহ : মমিনুল

অসহায় মানুষকে পুঁজি করে মিল্টন গড়ে তুলেছেন একাধিক কেন্দ্র, কিনেছেন জমি, গাড়ি। গড়ে তুলেছেন লাঠিয়াল বাহিনী। এ বাহিনী সস্তায় জমি বিক্রি করতে না চাইলে লোকজনকে ধরে এনে মারধর করত। নিজের বাবাকে পিটিয়ে ঢাকায় আসা মিল্টন বনে গিয়েছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে জমি দখলের। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নথি জাল করে বিভিন্ন চার্চ দখলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কালবেলা যা লিখেছে, অনেক কমই লিখেছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এখন বেরিয়ে আসছে অজগর। গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন, ‘মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে আরও ভয়াবহ-লোমহর্ষক ঘটনা আছে। তদন্ত শেষ না হলে এসব ঘটনা বলা ঠিক হবে না।’

মিল্টন সমাদ্দারের ঘটনা আমাদের সমাজব্যবস্থায় একটা বড় ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মানুষের বিশ্বাস টলে যাবে। অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা মানুষের সেবা করতে চান। কিন্তু নানান ব্যস্ততা ও উদ্যোগের অভাবে তা করতে পারেন না। বিশেষ করে প্রবাসী অনেকে দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চান। তারা মিল্টন সমাদ্দারের মতো লোকদের ওপর ভরসা করে অর্থ দেন। কিন্তু সেই অর্থের এমন অপব্যবহারে মানুষের ওপর আর মানুষ বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশে অর্থ উপার্জনের অনেক উপায় আছে। কেউ ব্যবসা করেন, কেউ প্রতারণা করেন। মিল্টন সমাদ্দাররা ব্যবসা করেন মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে। তার মূল পুঁজি মানুষের দারিদ্র্য আর অসহায়ত্ব। এ অসহায়ত্ব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে মানবিক মানুষের আবেগকে কাজে লাগান মিল্টনরা। অর্থ উপার্জনের নিকৃষ্টতম উপায় হলো মানুষের আবেগকে ব্যবহার করা।

আরো পড়ুন  নাপা সিরাপ নয়, মায়ের পরকীয়া প্রেমেই প্রাণ যায় দুই শিশুর

মিল্টন সমাদ্দারের ঘটনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে অসহায় মানুষের। মিল্টন একা নন, এমন আরও অনেকে অসহায় মানুষের সেবা করেন। মিল্টনের ঘটনায় মানুষের বিশ্বাস টলে গেলে অসহায় মানুষদের জন্য অর্থ আসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা কমে যে যাবে তা নিশ্চিত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে সারা দেশে এমন ৬৯ হাজার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আছে। সবই জনসেবা করে এটা হয়তো ঠিক নয়। আবার সবাই মিল্টন সমাদ্দারের মতো প্রতারকও নয়। সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, এসব সংগঠনের ব্যাপারে সঠিক তদন্তের। আর কোনো মিল্টন সমাদ্দার মানবতাকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে। যাতে সত্যিকারের সমাজসেবা যারা করেন, তারা নিরুৎসাহিত না হন। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। মানুষই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আর যেন মিল্টন সবার চোখের সামনে এ ধরনের নির্মমতা চালাতে না পারে। পুলিশ বা প্রশাসন যেন কালবেলার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা না করে। সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই সরকারের দায়িত্ব।

সর্বশেষ সংবাদ