কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রামের হতদরিদ্র মো. ইহছান আলী। বর্তমানে তার বয়স ৮২ বছর। তার বাবা নছর উদ্দিন মুন্সি অভাব অনটনের সংসারে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। ছেলে প্রাইমারির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে বন্ধ করে দেন পড়ালেখা।
তবে নছর মুন্সি ছিলেন ধর্মানুরাগী। তার স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় হয়ে মাওলানা হবে। তাই ছেলেকে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য তাবলিগ জামাতে পাঁচ বছরের চিল্লাতে পাঠিয়ে দেন। তাবলিগ জামাতের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচ বছর কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন ইনছান আলী।
নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি একটানা রোজা রাখতে শুরু করেন। এভাবেই কেটে গেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। বছরে শুধু পাঁচ দিন বাদে সারা বছরেই পালন করেছেন রোজা। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ইনছান আলী আল্লাহর কাছে সবসময় চাইতেন, আল্লাহতাআলা যেন তাকে হজ করার তৌফিক দেন।
চাওয়ার মতো চাইলে আল্লাহ যে নিরাশ করেন না, হয়তো তারই দৃষ্টান্ত ইনছান আলী। হজের খরচ বহনে নিজের সাধ্য না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সহযোগিতায় ১০ জুন হজ পালনের উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি।
একাধারে পঞ্চাশ বছর রোজা পালন ও হজে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইনছান আলী বলেন, গরিব ঘরে জন্ম আমার। পৈতৃক সূত্রে ১৪ শতাংশের বাড়ি ভিটা ও সামান্য কিছু ফসলি জমি ছাড়া আমার আর সম্পদ বলতে কিছুই নেই। অভাব অনটনের মাঝেও আমি কখনো রোজা ছেড়ে দিইনি। রোজা রাখতে গিয়ে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হতো। পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে গেছে। আমার ৬ ছেলের মধ্যে ২ ছেলে মারা গেছে। বাকি ৪ ছেলে সবাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। তিন মেয়ের সবাইকে বিয়ে দিয়েছি। তবে অভাব দূর হয়নি। ছেলেরা দিনমজুরি করে যা আয় রোজগার করে তা থেকে আমাকে কিছু দেয়। তাই দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়।
তিনি বলেন, অভাবের সংসারে রোজা রাখাও অনেক সময় কষ্টের হয়। অনেক দিন শুধু পানি খেয়ে রোজা রেখেছি। সেহরিতে খাবার না থাকায় মুড়ি, চিড়া কখনো কচু গাছ সেদ্ধ করে খেয়ে রোজা রেখেছি। যত কষ্টই হোক, রোজা ছাড়িনি। ইফতারে কখনো চকলেট কখনো শুধু পানি কখনো আবার গাছের পাতা চিবিয়ে ইফতার করতাম।
তিনি আরও বলেন, ইফতার করে নামাজ আদায় করে খোদাকে বলতাম খোদা যেন আমাকে হজ করার তৌফিক দেন। আমার নিজের তো হজের খরচ জোগানোর ক্ষমতা নেই। ছেলেরা যে আমাকে হজে পাঠাবে তাদেরও সাধ্য নেই। তবু হতাশ না হয়ে খোদার কাছেই চাইতাম। আল্লাহ আমার হজে যাওয়ার ইচ্ছা কবুল করেছেন। তার অসীম কুদরতে আমার হজে যাওয়ার উছিলা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাহালুল হক চৌধুরীকে পাঠিয়েছেন। ওই স্যারের সহযোগিতায় আগামী মাসের ১০ তারিখ পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশে রওনা দেব ইনশাআল্লাহ।
ইনছান আলীর প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ইনছান আলী চাচা প্রতিদিনই রোজা রাখেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন না। চাচা দেখা হলেই হজে যাওয়ার কথা বলতেন। আল্লাহ ওনার নিয়ত কবুল করেছেন।
হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ উমর ফারুক বলেন, আমি দীর্ঘ ছয়বার এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। সে সুবাদে তাকে আমি চিনি। অভাব অনটনের সংসারে থেকেও ইনছান আলী কখনও ধর্মবিমূখ হননি। টানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রোজা পালন করে আসছেন।